দেশেই তৈরি হচ্ছে সাপের বিষের প্রতিষেধক
বছরে সাশ্রয় হবে ১০ কোটি টাকা!
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাপে কাটলে ওঝার কাছে যেতে হবে, এটাই যেন নিয়ম! অথচ যথাযথ প্রতিষেধকের পরিবর্তে ওঝা ঝাড়ফুঁঁকের আশ্রয় নেয়ায় তৈরি হয় মৃত্যুঝুঁকি। তাই সাপের ছোবলে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে দেশেই বিষের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যেই সাফল্যের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শতভাগ কার্যকর না হলেও বর্তমানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতিষেধক এখন মূলত ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার ২০১৮ সালে দেশে এই প্রতিষেধক তৈরিতে উদ্যোগ নেয়।
সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলে বছরে সাশ্রয় হবে প্রায় ১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে এখন শুধু একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম বিপনন করে। ওষুধটির এক ভায়ালের দাম প্রায় এক হাজার টাকা।
এ জন্য আট কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছরের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। যেখানে কাজ করছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগ, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিক্যাল মেডিসিন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ এবং জার্মানির গ্যাটে ইউনিভার্সিটি।
প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়েছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।
প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জানান, ‘২০২২ সালের মধ্যে কার্যকর অ্যান্টিভেনম বাজারে আনার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। এরই মধ্যে তিনটি ধাপ শেষ হয়েছে। প্রতিষেধকটি এখন কেবল মানবদেহে প্রয়োগের ধাপটি বাকি। ’
ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ আরো বলেন, ‘সাপে কাটলে একজন মানুষের শরীরে তিন ধরনের প্রভাব পড়ে। সেগুলো হচ্ছে হেমোটক্সিন বা রক্ত দূষণ, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশি অকার্যকর এবং নিউরোটক্সিন বা মস্তিষ্কে অকার্যকর। বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ সাপে কাটার পর ওঝার কাছে যান। যথাযথ প্রতিষেধকের পরিবর্তে ওঝা ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেয়ায় তৈরি হয় মৃত্যুঝুঁকি। ’
দেশে অ্যান্টিভেনম রিসার্চ কোন পর্যায়ে আছে জানতে চাইলে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ বছর প্রকল্পের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। এরপর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়া হবে।’
বাংলাদেশে ৯৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি প্রজাতি বিষধর। যার মধ্যে ১২ প্রজাতি রয়েছে সাগরে। বাকিগুলো গহীন জঙ্গল ও লোকালয়ে বসবাস করে। বিষের প্রতিষেধক তৈরির প্রকল্পে পদ্ম গোখরো, খৈয়া গোখরো, কাল কেউটে, শঙ্খিনীসহ ১২ প্রজাতির ১৭০টি সাপ পোষা হচ্ছে।
মিজানুর রহমান জানান, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ থেকে সংগ্রহ করা বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনমের মান যাচাইয়ের জন্য এ বছরেই দেশের বাইরের ল্যাবে পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, ‘পাঁচটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রথম প্যাকেজে চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গায় থেকে সাপ সংগ্রহ ও সেগুলো লালন-পালন এবং পরিচর্যা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় প্যাকেজে বিষ সংগ্রহ এবং সেগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগের বিষয়টি রয়েছে।
তৃতীয় প্যাকেজে বিষগুলো দিয়ে একটি মডেল তৈরি এবং অ্যান্টিভেনমগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত করার কথা। এই তৃতীয় প্যাকেজ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে।’
এরপর চতুর্থ প্যাকেজে অ্যান্টিভেনমগুলো পরীক্ষামূলকভাবে সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরেও প্রয়োগ হবে অ্যান্টিভেনম। সবশেষ পঞ্চম প্যাকেজে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হবে অ্যান্টিভেনম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) শাখার পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনমের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার ভিত্তিতে প্রত্যেক বিভাগীয় হাসপাতালে বছরে ৫০০ ভায়াল, প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল এবং প্রত্যেক সদর হাসপাতালে ৫০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়।
‘দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা সফল হলে বাইরে থেকে এই প্রতিষেধক আর আনতে হবে না। দেশেই অনেক সাশ্রীয় দামে পাওয়া যাবে সাপের বিষের প্রতিষেধক।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। তাদের মধ্যে মারা যান ছয় হাজার।