সড়কপথে পতাকা হাতে ১৪৪ দেশ ভ্রমণ নাজমুনের
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের পতাকা হাতে ঘুরেছেন ১৪৪টি দেশের পথে পথে। মানচিত্র নিয়ে করেছেন গবেষণা, কিভাবে সবচেয়ে কম খরচে বিশ্বভ্রমণ করা যায়। নরওয়ের ‘সিস্টারহুড রিসার্চ’ ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিতে স্থান পেয়েছেন মুসলিম বিশ্বের সেরা নারীদের একজন হিসেবে। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পিস টর্চ বিয়ারারঅ্যাওয়ার্ড। ‘পতাকা কন্যা’ খ্যাত এই নারী বাংলাদেশের নাজমুন নাহার।
তার প্রাপ্তির ঝুলিতে গিয়েছে বহু অ্যাওয়ার্ড, সম্মাননা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক `পিস টর্চ বিয়ারার অ্যাওয়ার্ড’। এর আগে এ পুরষ্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন কার্ল লুইস, মিখাইল গর্বাচেভ, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অনেক বিখ্যাত মানুষেরা। বাংলাদেশ থেকেও তার অর্জনের ঝুলিতে গিয়েছে ‘অনন্যা শীর্ষ দশ আওয়ার্ড’। এছাড়া ২০১৯ সালে জন্টা ইন্টারন্যাশনাল তাকে দিয়েছে আরেক বিরাট সম্মাননা- গেমচেঞ্জার অব বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও মিস আর্থ কুইন অ্যাওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ডসহ দেশী ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও বেশ কয়েকটি সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।
সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের পাতায় যার নাম এখন আমরা পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের যার নাম স্থান পেয়েছে। নাজমুন নাহার সম্প্রতি মালদ্বীপে ১৪৪ তম দেশ ভ্রমণের রেকর্ড সৃষ্টি করেন। নাজমুন নাহার উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এবং এখন কাজ করছেন একজন গবেষক হিসেবে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে তিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন।
২০০০ সালে প্রথম ইন্ডিয়া দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্ৰমণ অভিযাত্রা। ২০ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর পথে পথে অভিযাত্রা করেছেন। সম্পূর্ণ ভ্রমণই ছিল একা একা, শুধু ১৪ টি দেশের ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তার মা। নাজমুন নাহার পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে একটা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখার জন্য এবং কম খরচে পৃথিবী ঘোরার জন্য তিনি সড়ক পথে ভ্ৰমণের পন্থা বেছে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ম্যাপের উপর রিসার্চ করেছেন কিভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়। তিনি শুধু কোন একটা দেশের শহর ঘুরে ফিরে আসেননি, তিনি উঠেছেন পেরুর রেইনবো সামিটের মতো পৃথিবীর বহু পর্বত সামিটে, যেখানে প্রচণ্ড আল্টিচুডের কারণে মৃত্যু মুখে পড়েও বিধাতার ইচ্ছায় আবার ফিরে এসেছেন মৃত্যুমুখ থেকে। চিলির আতাকামা যেখানে ১০০ বহুরে বৃষ্টি হয়নি এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছে নাজমুন নাহারের।
অনেক দ্বীপে রাতের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেছেন, আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে ৪ ঘণ্টা শুয়ে ছিলেন। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ঙ্কর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন, গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখোমুখি হয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে, শুধু কি তাই তিনি কিরগিজস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে উঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছোট একটা বুনো গাছের সাথে ঝুলে ছিলেন। উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নীচে ছিল গহীন ফঁকা যেখানে বাঁচার কোন উপায় ছিলনা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়েছেন সেখানেও।
বিশ্বভ্রমণ করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন আরও অনেক অজানা কাহিনী। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সাথে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, আফ্রিকাতে তিনমাস আলু খেয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ড আছে তার। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুইদিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিয়েছেন। যেহেতু তিনি সড়ক পথে ভ্রমণ করেছেন দিনের পর দিন, সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা বাসে, কখনও ৪৮ ঘণ্টা, কখনও ৩৬ ঘণ্টা তাকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে।
কিন্তু এত ভ্রমণের জন্য খরচের যোগান আসতো কোথেকে, এমন প্রশ্ন মনে উদয় হতেই পারে। বিষয়টি জানালেন নিজের মুখেই। ‘খরচের বিষয়ে আমি বরাবরই খুব স্পষ্টবাদী। যেহেতু সুইডেনে পড়াশোনা করতে গিয়েছি সেই ২০০৬ সালে। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতাম। সামারে কখনও ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা প্রচুর পরিশ্রম করে পয়সা জমাতাম শুধু ভ্রমণ করার জন্য। কম খরচে থাকতাম পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে, কখনো তাবু করে, কখনো কোচ সার্ফিং এর মাধ্যমে।’
‘মানুষের যখন স্বপ্ন, ইচ্ছে, একাগ্রতা, চেষ্টা থাকে আর সেই মানুষ যদি পরিশ্রমী হয় তাহলে তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। অনেক সময় বর্ডার ক্রস করতে না পেরে তাকে স্থানীয় অপরিচিত পরিবারের সাথে থাকতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, আমি জানতামই না যে একঘণ্টা পরে আমার জীবনে আসলে কি ঘটবে।’
আগামীকাল পহেলা জানুয়ারি চট্টগ্রামে ‘পতাকা কন্যা’ খ্যাত এই পরিব্রাজক নাজমুন নাহার এর সম্মানে অনুষ্ঠিত হবে সংবর্ধনা। বিকেল ৪ টায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি হলে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, কবি ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম, বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি সাংবাদিক এজাজ ইউসুফী, লক্ষ্মীপুর জেলা সমিতির সভাপতি, সাবেক কাউন্সিলর মো. এম. এ কাশেম, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নাট্যজন সাইফুল আলম বাবু।
নাজমুনের সম্মানে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
আরসি/কেএন